মনুষ্য-রক্তের শ্রেণির আবিষ্কার

মনুষ্য-রক্তের শ্রেণির আবিষ্কার

                                                        
আবিষ্কার : ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দ
বিজ্ঞানী : কার্ল ল্যাণ্ডস্টাইনার


১৭১৮ খ্রীষ্টাব্দে হারভে 'রক্তসংবহন' আবিষ্কার করার পর থেকেই ক্রমাগত প্রচেষ্টা চলেছিল মানুষের দেহে শোণিত সংক্রমণ করার জন্য । ফরাসী দার্শনিক ডেনিস এবং শল্যচিকিত্সক মারে প্রথম চেষ্টা চালান মানুষের দেহে ভেড়ার রক্ত (১৫০ মিলিলিটার) সংক্রমন করার । পরবর্তীকালে আরও অনেকে এই প্রচেষ্টা চালান কিন্তু ফল হয় মারাত্মক । ফলশ্রুতি হিসাবে শোণিত সংক্রমণ বন্ধ হয়ে যায় ।
এক শতাব্দী পরে আবার প্রচেষ্টা হয় শোণিত সংক্রমণের । ১৮১৯ খ্রী-তে ব্ল্যান্ডেল ইতিহাসে প্রথম সাফল্যের সঙ্গে শোণিত সংক্রমণ করান, একজন মানুষের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে । তবে সাধারণভাবে বলা যায় শোণিত সংক্রমণ প্রচেষ্টা হতাশাজনক হয়ে দাঁড়ায় ; কখনও বা রোগী সুস্থ হন, কখনও বা তাঁর মৃত্যু হয় । বস্তুতঃ, এর কারণ মানুষের কাছে অজ্ঞাত ছিল ।
অস্ট্রিয়া-র স্কলার কার্ল ল্যাণ্ডস্টাইনার এই বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন ১৯০০ খ্রী-তে । একটা টেস্ট টিউবে তিনি নিজের লোহিত রক্তকণিকা সঙ্গে মেশালেন নিজের শরীরের রক্তাম্বু (blood serum), কোনও পুঞ্জীভবন হতে দেখলেন না : যখন বিভিন্ন ব্যক্তির রক্তকণার সঙ্গে রক্তাম্বু মেশালেন, দেখলেন পুঞ্জীভুত হচ্ছে বা কখনও কখনও হচ্ছে না । এই ঘটনা অবশ্য অনেকেরই নজরে এসেছিল, কিন্তু ল্যাণ্ডস্টাইনার ছাড়া কেহই ব্যাখ্যা দিতে পারেননি । লোহিত রক্তকণিকার দু'প্রকারের বিশেষ গঠনবিন্যাস আছে যারা একত্রে অথবা আলাদা ভাবে থাকতে পারে । রক্তাম্বু-র একটি প্রতিরক্ষিকা (antibody) আছে, নাম লোহিত রক্তকণিকার ভিতরের বিশেষ গঠনের agglutinin; এই agglutinin যখন লোহিত রক্তকণিকার বিশেষ গঠনবিন্যাসের মধ্যে পড়ে, পূঞ্জীভবন হয় যা রোগীর রক্তসংবহন-কালে মারাত্মক হতে পারে । এর থেকে ল্যাণ্ডস্টাইনার একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মনুষ্য রক্ত-শ্রেণী হল বংশাণুধৃত ।১৯০৯ খ্রী-তে সমস্যার সমাধানকল্পে ল্যাণ্ডস্টাইনার রক্তকে চারটি শ্রেণী-তে ভাগ করলেন- A, B, AB এবং O। ডাক্তাররা রোগীর রক্ত পরীক্ষা করে সঠিক শ্রেণী নির্ধারণ করে রক্তসংবহন করতেন ।
যেহেতু রক্ত-সংবহন পূর্বে ধারাবাহিকভাবে বিফল হয়েছে, সাধারণ চিকিত্সকরা এটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতেন ; তবে বহু সংখ্যক বিজ্ঞানী এটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যাচ্ছিলেন । নাটকীয়ভাবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এনে দিল রক্ত-সংবহন পরীক্ষার এক বিশাল সুযোগ । যেহেতু যুদ্ধে আহতদের জীবন নিয়ে সমস্যা, রক্ত-সংবহন প্রথা হয়ে দাঁড়ালো আহতদের মৃত্যুর নিশ্চিত দরজা থেকে ফিরিয়ে আনার এক অস্ত্র । ডাঃ ওল্ডেনবার্গ প্রথম পুঞ্জীভবনের প্রতিক্রিয়া জানবার জন্য রক্ত-মিলান পরীক্ষা শুরু করলেন রক্ত-সংবহন প্রক্রিয়ার আগে । দু'জন ব্যক্তির মধ্যে রক্তসংবহন তখনই সম্ভব যখন কোনও পূঞ্জীভবন হবে না লোহিত রক্তকণিকা আর রক্তাম্বু মেশালে । এই প্রক্রিয়া বিশাল সাফল্য এনে দিল এবং প্রচুর জীবন বাঁচলো । পরবর্তী বত্সরগুলিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ব্যবহারের ফলে রক্ত-সংবহন হয়ে দাঁড়ালো একটি নিরাপদ ব্যবস্থা, এবং ১৯২০ খ্রী-র শেষদিকে ইয়োরোপ ও উত্তর আমেরিকায় রক্ত-সংবহন হয়ে দাঁড়ালো মেডিকেল শাস্ত্রের একটি সফল ও সর্বগ্রাহ্য প্রক্রিয়া ।
আমরা এখন জানি বিভিন্ন জাতির নরনারীর রক্ত-শ্রেণী বিভিন্ন রকমের । যথা, শ্রেণী O খুবই সাধারন UKতে, শ্রেণী B- এশিয়া মহাদেশে । O শ্রেণী হল সব থেকে পুরাণো- প্রস্তরযুগ থেকে এর অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে । শ্রেণীদ্বয় A ও B পরে এসেছে অভিপ্রয়াণ মারফত্, যেমন আফ্রিকা থেকে ইয়োরোপ খ্রী-পূর্ব ২০,০০০ থেকে ১০,০০০ -এর মধ্যে ।