পরকীয়ার ১১ তলা!


 
‘বিয়ে করবে না তো এভাবে ঘোরালে কেন’, ‘তুমি আমার শরীরটাকেই চেয়েছ, আমাকে নয়’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কে কাকে বোঝায়, বিয়ে করলে টোটাল পরকীয়াই মাটি। আর শরীর ছেড়ে একবার বেরিয়ে এসে দেখাও তো মাম্পি, কোনটা ‘তুমি’।

বাঙালির পরকীয়া সন্দর্ভ এক সাতকেলে পুরনো কাহিনি। সেই রামী-চণ্ডীদাস থেকে এই হালের টলিউডি কেত্তন, সেই একই থোড়-বড়ি-খাড়া। কিন্তু একটা প্রশ্ন মনে জাগতেই পারে, বাঙালি কি সামলাতে পারে তার এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ারের ঝক্কি? নাকি ছড়িয়ে সাতান্ন করে কিছু দিন যাওয়ার পর থেকে। তখন পাড়া-প্রতিবেশী, অফিস কলিগ, খুড়তুতো দাদা, সামনের ফ্ল্যাটের ঝিন্টিবৌদি— সব মিলেমিশে সে এক কেলোর কীর্তি। বঙ্গজনের পরকীয়া-যাত্রা হরাইজন্টাল না ভার্টিক্যাল, খোঁজ নিতেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন পরকীয়াকারীরা নেপথ্যে বাজতে লাগল সেই ১৯ শতকের ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটকের গান— ‘ওঠা নামা প্রেমের তুফানে’। সুতরাং, ধরে নিতে হল, আর যা-ই হোক, বাঙালির পরকীয়া এই ফ্ল্যাটবাড়ির বাজারে কিছুতেই আনুভূমিক নয়। তা বরং এক তে-ঢ্যাঙা বহুতলের লিফটের ওঠানামা হতে পারে। কিন্তু দার্শনিকরা বাধ সাধলেন। তাঁদের প্রশ্ন— ক’তলা বাড়ি সেটা? ১৫ কী ২০ তলা নিশ্চয়ই নয়। কারণ ১০ থেকে ১১ তলার মধ্যেই দম ফুরোয় বাঙালি পরকীয়াবাজদের। আদেশ শিরোধার্য। নীচে বর্ণনা করা হল বাঙালি পরকীয়ার সেই ১১টি তলাকে।

গ্রাউন্ড ফ্লোর: বেসমেন্টের শূন্যতায় ঘুরপাক খায় লিবিডো। বাসনাবিলাসের অঙ্গনে বার বার খোঁজ পড়ে— কোনও নতুন গাড়ি কি কেউ পার্ক করল?

ফার্স্ট ফ্লোর: তল্লাশ। ফেসবুক চলবে, বন্ধুর বাড়ির সান্ধ্য পার্টি চলবে। কিন্তু কখনওই ডেটিং সাইট চলবে না। কেমন যেন একটা ফেলো কড়ি মাখো তেল গন্ধ। তা ছাড়া ওটায় ব্যাপক ঘোটালা। কে যে কী ধান্ধায় ওই সব সাইটে নিজের নোটিস লটকেছেন, কে জানে! ফেঁসে যাওয়ার ভয় সাংঘাতিক। সে কারণেই বাঙালি ও লাইনে তেমন ঘোরাফেরা করে না। অ্যাফেয়ারেও যদি কড়ি ফেলতে হয় তো ভাঁড় মে যায় ওইসি কহানি।

সেকেন্ড ফ্লোর: মৃদু মৃদু রেস্তোরাঁ-বাহার। কাফেই বেশি। ক্যাপুচিনোয় গরম চুমুক। দিল ধক ধক। দিলে মাঝে মাঝেই ধড়কন। কথাবার্তায় ছিমছিমে ইনুয়েন্দো। শরীরী প্রসঙ্গ এসে যেন ধাক্কা মারে পদ্মদিঘির ঘাটে। জিয়ল মাছের ঝাঁক এসে ছড়িয়ে যায় আমিষগন্ধ। একটু হাত ধরা। ফেরার পথে মাপামাপি। দু’পক্ষই ঘাঘু, দু’জনেই ঝানু। কে কতখানি ওস্তাদ, সেটারই হিসেব চলে মনে মনে।
থার্ড ফ্লোর: গাঢ়, ঘন রেস্তোরাঁ-বাহার। লাঞ্চ-ডিনার। মোমবাতির আলো। ব্যাকগ্রাউন্ডে হালকা জ্যাজ নয়তো চৌরাসিয়া। রোম্যান্সে ধাক্কা দেয় মটন-ভিন্দালু, চিকেন টেট্রাজেনি। আমিষে আমিষ তুমি নীলিমায় নীল। গাড় হয় রাত। হালকা ওয়াইনের নেশা। সামান্য ড্রাইভ। কথায় উঁকি দেয় সীমানা টপকানোর সম্ভাবনা।

ফোর্থ ফ্লোর: ঘন ঘন রেস্তোরাঁ-বাহার। আরও একটু লং ড্রাইভ। বিয়ারের ক্যান। চিপস। সন্ধে ঘনায় মালঞ্চ কি নামখানায়। একটু ভারী রাত। কার স্টিরিও-য় গ্ল্যাম রক— ‘বেইবি ওঞ্চু টেল মি হোয়াই।’ ঝোপের ধারে ঘ্যাঁস শব্দে পার্ক। ক্যাসানোভা গতিতে চুমু। হাত খুবই বিপজ্জনক জায়াগায়। একটু ছিমনামি। ‘আজ নয়’। ‘ডোন্ট বি সো ফাস্ট’। বাকি পথ রবীন্দ্রনাথ— ‘কী পাইনি তার হিসাব মেলাতে...।’

ফিফ্‌থ ফ্লোর: আউটিং। রিসর্ট। সারা দিনের মামলা। সুইমিং পুলের ধারে ছাতা। বিয়ার। চিকেন টিক্কা। দুপুর ঘনায়। এসি রুমে কিরকিরে নৈঃশব্দ। হৃৎপিণ্ডে দারুণ দামামা নাটাগুরু নাটাগুরু। আশ্লেষ। কিসি কিসি ব্যাং ব্যাং। মিলনের বাহানা। ভ্যানতারা। তার পর...। ঘাম। দীর্ঘশ্বাস। ফেরার পথে মান্না দে— ‘কী চেয়েছি আর...’।

সিক্সথ ফ্লোর: তিন দিনের ছুটি। বাড়িতে বলে আসা অফিস-ট্যুর। গালুডি কি মাইথন। হোটেলের ঘরে ভারী পর্দা থির থির করে কাঁপে। শরীরে শরীর। মন নাই কুসুমসোনা। ওসব কবে ভেসে গেছে গাঙুরের স্রোতে।
সেভেন্থ ফ্লোর: শহরের ভিতরেই ক্লামজি গেস্ট হাউস। অথবা বন্ধুর ফাঁকা ফ্ল্যাট। কথা কম কাজ বেশি।
এইটথ ফ্লোর: ‘অ্যাই, এভাবে কত দিন’, ‘আর তো পারছি না’, ‘তুমি কি কিছুই বোঝ না’। মিলনের শ্বাসরোধী কথার পরে ঘ্যানর ঘ্যানর। ফেরার পথে মাথায় ঘুরপাক— এমন কথা তো ছিল না সোনা।

নাইন্থ ফ্লোর: ‘বিয়ে করবে না তো এভাবে ঘোরালে কেন’, ‘তুমি আমার শরীরটাকেই চেয়েছ, আমাকে নয়’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কে কাকে বোঝায়, বিয়ে করলে টোটাল পরকীয়াই মাটি। আর শরীর ছেড়ে একবার বেরিয়ে এসে দেখাও তো মাম্পি, কোনটা ‘তুমি’। কেউ কথা শোনে না। কাঁইমাই। ধুপধাপ। কখনও কখনও ঠাসঠাসও।
লিফ্ট নেমে যায় গ্রাউন্ড ফ্লোরে। উঠে আসে শূন্য খাঁচা।

টেন্থ ফ্লোর: খেল খতম। সোসাইটিতে গসিপ। ক’দিনের ছুটি। সপরিবারে রাজস্থান অথবা ব্যাঙ্কক। ফেসবুকে রেগুলার পোস্ট— সানগ্লাসে গিন্নি, পাশে খোকা। তলায় কমেন্ট ‘হ্যাপিলি ফরএভার’। লাইক লাইক লাইক। বাড়ি ফিরে রাতের শুনাপন। সিঙ্গল মল্টের গাঢ় গোমেদবর্ণ। বিরহ বড় ভাল লাগে।

রিংয়ের লহর তোলে মুঠোফোন। হাস্কি গলায় কেউ বলে ওঠে— ‘হাই...’ 

প্রকাশিতঃ ৬ই জুন, ২০১৬ l জীবনযাপন