- বর্তমানে সমাজ ও সংস্কৃতির নতুন প্রতিবেদনগুলি পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ভূমিকা :
ইউনিফাইড স্ক্রিপ্ট বা সমন্বিত লিপি হচ্ছে এমন একটি লিপি যা দিয়ে পৃথিবীর সব ভাষা লেখা সম্ভব ।সমন্বিত লিপি আবিষ্কার পৃথিবীর প্রখ্যাত ভাষাবিদদের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শাসক কুবলাই খান একজন তিব্বতী লামাকে ঐ সময়ে তিব্বত ও তার আশে পাশের অঞ্চলে প্রচলিত ভাষাগুলি লেখার উপযোগী একটিমাত্র লিপি উদ্ভাবনের দায়িত্ব প্রদান করেন। এই লামা যে লিপি উদ্ভাবন করেন তার নামে পাগস্ পা ( লিঙ্ক: http://babelstone.blogspot.com)। বলাবাহূল্য, সঙ্গতঃ কারনেই এই লিপি জনপ্রিয় হয়নি। এর পর হাজার হাজার পন্ডিত ব্যাক্তি উন্নততর সমন্বিত লিপি আবিষ্কারের চেষ্টা করেন । ভিতেলী ভিতেশ নামে একজন রাশিয়ান শিল্পী দীর্ঘ ২২ বৎসর পরিশ্রম করে ১৯৯৭ সালে ইন্টারব্রেট (লিঙ্কঃ :http://www.astrolingua.spb.ru/ ENGLISH/ inter_eng.htm and semiravet@yandex.ru) নামে একটি সমন্বিত লিপি আবিষ্কার করেন এবং দাবী করেন যে, তার লিপির সাহায্যে পৃথিবীর সকল ভাষা লেখা সম্ভব। বাস্তব সত্য এই যে, তাদের লিপিও জনপ্রিয় হয়নি।
২০০৯ সালের ২৪শে নভেম্বর “সাস” সমন্বিত লিপি আবিষ্কৃত হয় । এই তারিখে এটি ক্যানাডা ও আমেরিকার ট্রাফোর্ড পাবলিশিং থেকে ‘SUS FOR WRITING MULTIPLE LANGUAGES’ (ISBN: 978-1-4269-0939-9, লেখক ঃ ডাঃ মীরা রানী শর্মা পারই ও অধ্যাপক বিজন বিহারী শর্মা) নামে একটি কপিরাইটকৃত পুস্তকে প্রকাশিত হয় । এর পর ২০১০ এর জুলাই মাসে “প্রিয় অষ্ট্রেলিয়া ডট কম”-এ এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় (লিঙ্কঃ www.priyo-australia,.au / Articles/ Bangladeshi Scholars Invented Unified Scripts to Write All the Languages of the World) । একই সালের ১৯ শে জুলাই অষ্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা রেডিও থেকে এ বিষয়ে একটি বেতার সাক্ষাৎকার প্রচরিত হয়, যা এই লিঙ্কটি ব্যবহার করে শোনা যেতে পারেঃ : http://www.banglaradio.org.au/BR-Archive-2010-Summary.htm ।এর পর আগষ্ট ২০১০ এ জার্মানী থেকে প্রকাশিত হয় "SUS", THE LATEST UNIFIED SCRIPT(ISBN 978-3-8383-7411-6। অধ্যাপক বিজন বিহারী শর্মা ও ডাঃ মীরা রানী শর্মা পারই ) ।
“সাস” এর পূর্ণরূপ “শর্মা'স ইউনিফাইড স্ক্রীপ্ট” । ‘শর্মা’ এই লিপির আবিষ্কারকদের পারিবারিক উপাধি । আগে আবিষ্কৃত সকল সমন্বিত লিপিকারদের মতই সাসলিপির এই উদ্ভাবকগণও দাবী করছেন যে এরমাধ্যমে পৃথিবীর সকল ভাষা লেখা সম্ভব । এই দাবীর সত্যতা প্রমানে সময়ের প্রয়োজন । বাংলাভাষা লেখার ক্ষেত্রে এখন যেসব সমস্যা আছে, সাসলিপির সাহায্যে লেখা হলে তার অধিকাংশই থাকবে না বলে এই উদ্ভাবকগণ দাবী করেছেন ।
সাসলিপি কেন ?
সঙ্গতঃ কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে, পূর্বে আবিষ্কৃত একটি সমন্বিতলিপিও জনপ্রিয় না হবার পরেও সাসলিপির আবিষ্কারকদের আশান্বিত হবার কারন কি ? এ প্রশ্নের জবাবে প্রথমেই আলোচনা করা যাক, কেন পূর্বে আবিষ্কৃত সমন্বিত লিপিগুলি জনপ্রিয় হয়নি ।
সমন্বিতলিপির পূর্বের সকল আবিস্কারকই লিপি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে প্রধানতঃ একটি পন্থা অবলম্বন করেছেন। এটি হল, পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় ব্যবহৃত বর্ণের মধ্যে যেগুলির উচ্চারণ একই বা একই রকম(যেমন ঃ বাংলা “ক”, ইংরেজী “k” এবং আরবী “কাফ”), সেগুলিকে চিহ্নিত করা এবং তারপর এইবর্ণগুলি লেখার জন্য পুরানো বা নতুন কোন চিণ্হ বা হরফ ব্যবহার করা।
এই প্রচেষ্টার দুটি প্রধান সমস্যা আছে । প্রথমতঃ বিভিন্ন ভাষার বর্ণমালায় ঠিক একই উচ্চারনের বর্ণের সংখ্যা নগন্য । আবার সমোচ্চারিত বা প্রায় সমোচ্চারিত কিছু বর্ণ থাকলেও ব্যবহারের স্থানভেদে তাদের উচ্চারণ বদলে যায় । যেমন, বাংলা “ক”, ইংরেজী “k” বা “c” এবং আরবী “কাফ” এর প্রকৃত উচ্চারণ সব সময় এক নয়। এর ফলে একটি মাত্র লিপির সাহায্যে বিভিন্ন ভাষার বর্ণ উচ্চারণ করতে গেলে তা কোনএকটি ভাষায় ঠিক থাকলেও অন্য ভাষায় বিকৃত হয়ে যায় । তাই এই নিয়মে লিপি ব্যবহার করা হলে ভাষা তার পূর্বের উচ্চারন হারায় । মানুষ কোনভাবেই চায় না যে তার ভাষা বিকৃত হোক । বাংলাদেশে এই ভাষার জন্য মানুষ জীবন বিসর্জন দিয়েছে ।
দ্বিতীয় সমস্যাটি হচ্ছে, ভাষা লেখার যে লিপিগুলি আমরা ব্যবহার করি তা কোন বিজ্ঞানসম্মত চেষ্টার ফসল নয়, একথা সবারই জানা আছে । প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মূলত “চেষ্টা ও সংশোধনী”র মাধ্যমে এগুলি গড়ে উঠেছে । অনেক ক্ষেত্রেই এগুলি লেখা বেশ কষ্টকর, সময়সাপেক্ষ এবং ভালো করে না লিখলে পাঠোদ্ধারও অসম্ভব । কিন্তু তা স্বত্তেও কেউ যখন ঐ লিপির বদলে অন্য কোন লিপি লেখার প্রস্তাব নিয়ে আসবে, তখন স্বাভাবিক কারনেই মানুষ বলবে, ‘অনেক কষ্ট করে এগুলো লেখা আয়ত্ব করেছি, এখন তা কেন বদল করবো ?’ তবে এ কথা সত্য যে তা তারা করতে রাজী হবে যদি নতুন লিপির কোন বিশেষ সুবিধা বা গুণ থাকে ।
সাসলিপির বৈশিষ্ট্যঃসাস কোন পূর্ণাঙ্গ ভাষা নয়, এটি একটি লিপি । এই লিপির নিজস্ব কোন উচ্চারন নেই, বরং যে ভাষা লিখতে সাস লিপি ব্যবহার করা হয় লিপিগুলি সেই ভাষার বর্ণগুলির প্রচলিত উচ্চারণই গ্রহন করে । এর ফলে ভাষার কথ্যরূপটি একেবারে অবিকৃত থাকে, কেবলমাত্র তার লিখিত রূপটি বদলে যায় । পূর্বে আবিষ্কৃত সমন্বিত লিপিগুলি যেখানে লিপি নির্ধারন করতো উচ্চারণের মিলের উপর ভিত্তি করে, সেখানে সাসলিপিতে লিপি নির্ধারণ করা হয় বর্ণমালায় প্রতিটি বর্ণের গানিতিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে ।
এখন আমরা সাসলিপির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি বর্ণনা করবো ।
১। সাসলিপির বর্ণগুলি একটি অত্যন্ত সহজ নিয়ম বা মূলসূত্র অনুসরন করে তৈরী করা হয়েছে । এই সূত্রটি এত সোজা যে কোন শিশুকে তা বুঝিয়ে দিলে সে নিজেই বর্ণগুলি পর পর তৈরী করে নিতে পারে ।
২। সাসলিপির বর্ণগুলি সিম্বল বা আকার এর পরিবর্তে শুধুমাত্র সোজা দাগ (STROKE) দিয়ে তৈরী, যেখানে কোনাকুনি যাওয়া, বাঁকানো, প্যাঁচানো, এক দাগের উপর দিয়ে আবার দাগ দেয়া, পেছনে এসে বর্ণের উপরে/ নীচে/ আগে/ পরে চিহ্ন দেয়া, এসব কিছুই নেই । ফলে লিপিগুলি অত্যন্ত সহজে এবং দ্রুত লেখা যায় । আবার ব্যক্তির ভিন্নতার কারণে লিখিত লিপি পাঠে ভুল বোঝাবুঝির(CONFUSION) সম্ভাবনাও থাকে না । একই কারনে ব্যক্তিভেদে হাতের লেখা ‘ভাল’ বা ‘মন্দ’ হবারসম্ভাবনাও কমে যায় ।৩। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাত্র ২, ৩ বা ৪টি দাগ (চিত্র-১) দিয়ে লিপিগুলি তৈরী করা হয়েছে বলে এগুলি লেখা ও চেনা অত্যন্ত সহজ । সাধারন ভাবে যে সব ভাষা শুধুমাত্র বর্ণের মাধ্যমে লেখা হয় তা লেখার জন্য ৪টি এবং যে সব ভাষায় বর্ণ ও বর্ণচিহ্ন ব্যবহৃত হয়, তাদের জন্য সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ টি স্ট্রোকের প্রয়োজন হয়।৪। কম সংখ্যক স্ট্রোক দিয়ে তৈরী বলে এগুলি টাইপ করার জন্য স্বল্পসংখ্যক চাবি (KEY) লাগে । সাসলিপি তৈরীর মূলসূত্রঃসাসলিপি এমন একটি লিপি যা কয়েকটি মূলসূত্র জানার পর যে কেউ নিজেই তৈরী করে নিতে পারে । এই মূলসূত্রগুলি হচ্ছে,১। প্রতিটি হরফ একটি বর্গক্ষেত্রের মধ্যে আবদ্ধ থাকবে, কোন চিহ্ণই এই বর্গক্ষেত্রের বাইরে যাবে না ।
২। প্রতিটি হরফে বর্গক্ষেত্রের মাঝ বরাবর থাকবে একটি আনুভূমিক লাইন (১নং চিত্র, প্রথম লাইন)।
৩। বিভিন্ন ভাষার বর্ণগুলির প্রতি ৫টিকে নিয়ে একটি গ্রুপ বা বর্গ তৈরী করা হবে । এর প্রথম বর্ণটি হবে বর্গ প্রধান । বাংলায় এটি প্রচলিত আছে । অন্য ভাষায়ও এভাবে ৫টির বর্গ তৈরী করায় কোন সমস্যা নেই ।
৪। সাসলিপিতে প্রথমে বর্গপ্রধানগুলি তৈরী করা হবে । এ কাজে প্রথমে আনুভূমিক লাইন (১নং চিত্র,প্রথম লাইন) টি ব্যবহার করা হবে। এরপর উলম্ব অর্ধ-লাইন (১নং চিত্র, দ্বিতীয় লাইন) টি আনুভূমিক লাইনের নীচে বাম থেকে শুরু করে একে একে ২নং চিত্রে দেখানো ৪টি স্থানে ঘড়ির কাঁটার বরাবরে ঘুরে ঘুরে বর্গপ্রধানগুলি তৈরী করবে । ২নং চিত্র দেখানো ৪টি স্থান হলো, (প্রথম)নিচে বামে, (দ্বিতীয়) উপরে বামে, (তৃতীয়) উপরে ডানে এবং (শেষে) নীচে ডানে । এই নিয়মে ১৪ টি বর্গ প্রধান তৈরী করা সম্ভব। ১৪টি বর্গ প্রধান থেকে (৫ X ১৪ =) ৭০টি বর্ণের বর্ণমালা তৈরী করা যায় । কোন ভাষার বর্নসংখ্যা বেশী হলে প্রয়োজনে আরো ছোট উল্লম্ব লাইন ব্যবহার করে আরও ১৪ টি বর্গপ্রধান তৈরী করা যায়।
৫। বর্গপ্রধান তৈরী করার পর প্রতিটি বর্গপ্রধান থেকে এই বর্গের অন্য বর্ণগুলি তৈরী করা হবে । এটি করার জন্যও একই নিয়ম অনুসরণ করা হবে । এক্ষেত্রে ছোট উলম্ব লাইন (১নং চিত্র, তৃতীয় লাইন) টি বর্গপ্রধানটির ৩নং চিত্রে দেখানো ৪ টি স্থানে ক্রমান্বয়ে ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরে ৪টি বর্ন তৈরী করবে । নীচের ছবি দেখুন :
এখন আমরা সাসলিপির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি বর্ণনা করবো ।
২। প্রতিটি হরফে বর্গক্ষেত্রের মাঝ বরাবর থাকবে একটি আনুভূমিক লাইন (১নং চিত্র, প্রথম লাইন)।
৩। বিভিন্ন ভাষার বর্ণগুলির প্রতি ৫টিকে নিয়ে একটি গ্রুপ বা বর্গ তৈরী করা হবে । এর প্রথম বর্ণটি হবে বর্গ প্রধান । বাংলায় এটি প্রচলিত আছে । অন্য ভাষায়ও এভাবে ৫টির বর্গ তৈরী করায় কোন সমস্যা নেই ।
৪। সাসলিপিতে প্রথমে বর্গপ্রধানগুলি তৈরী করা হবে । এ কাজে প্রথমে আনুভূমিক লাইন (১নং চিত্র,প্রথম লাইন) টি ব্যবহার করা হবে। এরপর উলম্ব অর্ধ-লাইন (১নং চিত্র, দ্বিতীয় লাইন) টি আনুভূমিক লাইনের নীচে বাম থেকে শুরু করে একে একে ২নং চিত্রে দেখানো ৪টি স্থানে ঘড়ির কাঁটার বরাবরে ঘুরে ঘুরে বর্গপ্রধানগুলি তৈরী করবে । ২নং চিত্র দেখানো ৪টি স্থান হলো, (প্রথম)নিচে বামে, (দ্বিতীয়) উপরে বামে, (তৃতীয়) উপরে ডানে এবং (শেষে) নীচে ডানে । এই নিয়মে ১৪ টি বর্গ প্রধান তৈরী করা সম্ভব। ১৪টি বর্গ প্রধান থেকে (৫ X ১৪ =) ৭০টি বর্ণের বর্ণমালা তৈরী করা যায় । কোন ভাষার বর্নসংখ্যা বেশী হলে প্রয়োজনে আরো ছোট উল্লম্ব লাইন ব্যবহার করে আরও ১৪ টি বর্গপ্রধান তৈরী করা যায়।
৫। বর্গপ্রধান তৈরী করার পর প্রতিটি বর্গপ্রধান থেকে এই বর্গের অন্য বর্ণগুলি তৈরী করা হবে । এটি করার জন্যও একই নিয়ম অনুসরণ করা হবে । এক্ষেত্রে ছোট উলম্ব লাইন (১নং চিত্র, তৃতীয় লাইন) টি বর্গপ্রধানটির ৩নং চিত্রে দেখানো ৪ টি স্থানে ক্রমান্বয়ে ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরে ৪টি বর্ন তৈরী করবে । নীচের ছবি দেখুন :