Space Exploration Technology – SpaceX এর ভিনগ্রহে মানব বসতি স্থাপন


ফ্লোরিডা’র কেনেডি স্পেস সেন্টারের ঐতিহাসিক 39A Launch Pad থেকে গত ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ তারিখে স্থানীয় সময় বিকাল ৩:৪৫ মিনিটে SpaceX এর অত্যাধুনিক অবতরণ ক্ষমতাসম্পন্ন উচ্চমাত্রার ভরবহনে সক্ষম রকেট বা উৎক্ষেপণযান “Falcon Heavy” এর প্রথম পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠিত হয়। এই 39A Launch Pad থেকেই উড্ডয়ন করেছিল ১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো-১১ মিশনের মহাকাশযান, যে মিশনে মানুষ চাঁদের বুকে পা রাখে; এখান থেকেই উৎক্ষিপ্ত হয়েছিল প্রথম স্পেস শাটল কলম্বিয়া। এবার ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রকেটের প্রথম টেস্ট ফ্লাইটের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইল 39A Launch Pad.
Launch Pad A, B and Control Center: Kennedy Space Center Launch Complex 39
২০০২ সালে CEO & Lead Designer ‘Elon Musk’ এর হাত ধরে Falcon Heavy এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান SpaceX যাত্রা শুরু করে। যাত্রা শুরুর পর অল্প সময়ের মধ্যেই মহাকাশভ্রমণ ও মহাকাশযান বিষয়ক গবেষণায় একের পর এক সফল মাইলফলক স্থাপন করতে করতে এধরণের ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকার শীর্ষে অবস্থান নেয় SpaceX.

Space Exploration Technology – SpaceX এর সাফল্যের ইতিহাস

প্রতিষ্ঠিত হবার মাত্র আট বছরের মাথায় ২০১০ সালের জুন মাসে SpaceX এর উৎক্ষেপণযান Falcon 9 এর প্রথম সফল উড্ডয়ন সংঘটিত হয় ও পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছায়। Falcon Heavy রকেটটি সেই Falcon 9 রকেটের উন্নত ও পরিবর্ধিত রূপ। রকেট তৈরির সাথে সাথে নতুন ধরণের মানুষ ও মালামাল বহন উপযোগী মহাকাশযান (Spacecraft) তৈরির গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিল SpaceX. এর ফলাফল হিসেবে একই বছর ডিসেম্বরে SpaceX উদ্ভাবিত স্পেসক্রাফট Dragon পৃথিবীর কক্ষপথে প্রেরিত হয়। ঘণ্টায় ১৭ হাজার মাইল বেগে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে Dragon spacecraft পৃথিবীতে ফিরে আসে ও প্রশান্ত মহাসাগরে অবতরণ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মত কোনো ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠানের স্পেসক্রাফট মহাকাশভ্রমণ শেষে পৃথিবীর বুকে ফিরে এলো। SpaceX এর ড্রাগন মহাকাশযান উৎক্ষিপ্তও হয়েছিল নিজস্ব রকেট Falcon 9 এর মাধ্যমে। প্রথম পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের মাত্র দেড় বছর পর ২০১২ সালের মে মাসে প্রথম সফল বাণিজ্যিক উড্ডয়ন ঘটে Falcon 9 ও Cargo Dragon এর। এই প্রথম কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে মালামাল সরবরাহের মহাকাশযাত্রা পরিচালনা করলো।
পৃথিবীর কক্ষপথে কিংবা পৃথিবীর বাইরে কোনো নভোচারী বা বস্তু পাঠাতে যে পূর্ণাঙ্গ নভোযান উৎক্ষিপ্ত হতে দেখা যায় সেটি মূলত দুটি যানের সমন্বয়ে গঠিত। উৎক্ষেপণযান (Launch Vehicle or Rocket) ও মহাকাশযান (Spacecraft)। স্পেসক্রাফট হচ্ছে মানুষ কিংবা মালামাল বহনকারী অংশ যেটি সর্বশেষ গন্তব্যে পৌঁছুবে। আর স্পেসক্রাফটকে অভিকর্ষ অতিক্রম করে কক্ষপথে কিংবা পৃথিবীর বাইরে পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় গতিতে উৎক্ষেপণ করার কাজে ব্যবহৃত যানটি হল উৎক্ষেপণযান। জীবনরক্ষাকারী-ব্যবস্থাসম্পন্ন নভোচারী বহনযোগ্য মহাকাশযানকে Crew spacecraft এবং মালামাল বহন করতে ব্যবহৃত মহাকাশযানকে Cargo spacecraft বলে। উৎক্ষেপণযানে করে মহাকাশযান হোক, স্যাটেলাইট হোক আর আবর্জনাই হোক, যাই মহাকাশে প্রেরণ করা হয় সেগুলোর সাধারণ নাম পে-লোড।
সফল বাণিজ্যিক কার্গো স্পেসক্রাফট ফ্লাইট পরিচালনার পর SpaceX নজর দিল যুগান্তকারী এক আবিষ্কারের দিকে; রকেট অবতরণ পদ্ধতি ও পুনঃব্যবহার উপযোগী রকেট (Reusable Rocket) তৈরির গবেষণায়। এর আগে সকল রকেট বা উৎক্ষেপণযান মাত্র একবারই ব্যবহার করা যেত। সহজে বলা যেতে পারে রকেট মাত্রই ছিল ‘one time use’. রকেট পে-লোডকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে নিক্ষেপ করে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘মহাকাশের আবর্জনা’ (Space Debris) হিসেবে ঘুরতে থাকত পৃথিবীকে কেন্দ্র করে। অথচ এই প্রতিটি রকেটই ছিল একেবারে নতুন একেকটি উৎক্ষেপণযান। মাত্র একবার উৎক্ষিপ্ত হয়েই সেগুলো লিপিবদ্ধ হত অপচয়ের খাতায়। যদি এই রকেটকে মহাকাশে ছুঁড়ে ফেলে না দিয়ে কোনোভাবে ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করানো যায় ও আবার উৎক্ষেপণ করা যায় তবে একদিকে যেমন Space Debris তৈরি হবে না তেমনি রকেট উৎক্ষেপণ খরচ কমে আসবে বিপুল পরিমাণে। আর সেই তাক লাগানো কাজটি করতেই সফল হয়েছে SpaceX.
এমন যুগান্তকারী আবিষ্কার স্বভাবতই একবারে হুট করে ঘটে যাবার বিষয় নয়। বহুদিনের গবেষণা, পরীক্ষানিরীক্ষার সফলতায় পাওয়া যায় এমন আবিষ্কার। পুনঃব্যবহারযোগ্য রকেটের আবিষ্কারও তেমনি একটি বহুদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল। Grasshopper প্রজেক্ট এর মাধ্যমে শুরু হয় অবতরণ ক্ষমতা সম্পন্ন রকেটের আবিষ্কার কর্মকাণ্ড। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথমবারের মত মাত্র ৬ ফুট উচ্চতায় উঠে সফলভাবে অবতরণকরতে সক্ষম হয় অবতরণের জন্য প্রয়োজনীয় গাঠনিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন প্রোটোটাইপ রকেট Grasshopper। রকেটটি উঠেছিল মাত্র ছয় ফুট উপরে কিন্তু তা রকেট বিজ্ঞানকে নিয়ে গিয়েছিল এক অনন্য উচ্চতার দুয়ারে। এরপর পর্যায়ক্রমে এগিয়ে চলে, উন্নত থেকে উন্নততর হতে থাকে Grasshopper প্রজেক্ট। উচ্চতা বাড়তে থাকে Grasshopper এর উড্ডয়নের, কক্ষপথ থেকে ফিরে আসা রকেটকে অবতরণ করাতে সক্ষম হওয়ার মত সক্ষমতা অর্জন করার লক্ষ্যে।
Grasshopper – Prototype of the Rocket of new era.
  • তিন মাস পর ডিসেম্বরে উড্ডয়ন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ মিটারে
  • আরো তিন মাসের গবেষণায় ২০১৩ সালের মার্চ মাসে উড্ডয়ন উচ্চতা হয় ৮০ মিটার
  • দুরন্ত গতিতে উড়তে থাকা ‘গ্রাসহপার’ এক মাসের মধ্যেই উচ্চতা বাড়িয়ে ফেলে ৩ গুণ। উঠে যায় ২৫০ মিটার উচ্চতায়
  • পরবর্তী লাফে আরো ৭৫ মিটার এগিয়ে যায় দুই মাসের চেষ্টায়। লাফ দেয় ৩২৫ মিটার উঁচুতে
  • ইতোমধ্যে গ্রাসহপার প্রজেক্ট পার করেছে প্রায় এক বছর। ২০১৩ সালের আগস্টে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পরে গ্রাসহপার। ২৫০ মিটার উচ্চতায় উঠে আনুভূমিকভাবে ১০০ মিটার দূরত্বে অতিক্রম করে অবতরণ করে গ্রাসহপার। ১০ তলা ভবনের চেয়েও উঁচু গ্রাসহপারকে ১০০ মিটার দূরত্বে নিয়ে উলম্বভাবে অবতরণ করানো ছিল এই প্রজেক্টের অন্যতম কঠিন ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ।
  • আরো দু’মাস পর গ্রাসহপার অতিক্রম করল আধ মাইল, প্রায় ৭৪৪ মিটার উচ্চতা
  • এতগুলো ধাপে সফলতার পর শুরু হল fixed landing leg এর গ্রাসহপার প্রোটোটাইপের বদলে folding landing leg বসানো মূল Falcon 9 রকেট এর অবতরণ নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম। এর মধ্যে SpaceX এর অন্যান্য বাণিজ্যিক ও পরীক্ষামূলক রকেট উৎক্ষেপণ চলছিল। সেখান থেকেও উৎক্ষিপ্ত রকেট পুনরায় পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনে সফল অবতরণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ ও গবেষণা কার্যক্রম চলেছে
  • অবশেষে ৬ ফুট লাফ দেয়ার তিন বছর পর ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে OBRCOMM-2 মিশনে ১১ টি স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপনের উদ্দেশ্যে উৎক্ষিপ্ত Falcon 9 রকেট প্রথমবারের মত সফল ভাবে ভূমিতে অবতরণ করে। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম কোনো রকেটের সফল অবতরণ।
  • পরবর্তীতে চার মাস পর, ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে CRS-8 মিশনে উৎক্ষিপ্ত Falcon 9 রকেট সমুদ্রপৃষ্ঠে Droneship এর উপর সফলভাবে অবতরণ করে। ভূমিতে ও সমুদ্রপৃষ্ঠে ড্রোনশিপের উপর পুনঃব্যবহারযোগ্য উৎক্ষেপণযানের সফল অবতরণের মধ্য দিয়ে রকেটের ইতিহাসে নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটে।
এই সময়ের মধ্যে Reusable Rocket তৈরি কার্যক্রম ছাড়াও SpaceX নাসার হয়ে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে মালামাল সরবরাহ, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য পৃথিবীর কক্ষপথে কৃত্রিম উপগ্রহ (Satellite) স্থাপন ইত্যাদি নানাবিধ বাণিজ্যিক মিশন পরিচালনা করেছে। এগুলো ছিল Cargo spacecraft বহনকারী মিশন।
২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে CRS-8 মিশনে অবতরণে সফল Falcon 9 রকেটের দ্বিতীয় ফ্লাইট অনুষ্ঠিত হয় ২০১৭ সালের মার্চ মাসে। মহাকাশ গবেষণা ক্ষেত্রে পুনঃব্যবহারযোগ্য রকেটের প্রথম পুনঃউৎক্ষেপণের ইতিহাস রচিত হল। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে CRS-4 মিশন থেকে ফেরা Dragon Cargo spacecraft এর রি-ফ্লাইট হল ২০১৭ সালের জুন মাসে। আর সর্বশেষে ২০১৮ সালের শুরুতেই ছিল Falcon Heavy উৎক্ষেপণযানের প্রথম সফল পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন, পে-লোড কক্ষপথে প্রেরণ ও রকেট অবতরণ।

Falcon 9 Launch Vehicle এর গঠন কাঠামো

Falcon 9 Launch Vehicle
পুনঃব্যবহারযোগ্য রকেট তৈরির চিন্তা প্রথম থেকেই মাথায় রেখে কাজ করে এসেছে SpaceX. তাই আক্ষরিক অর্থেই একেবারে গোড়া থেকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে Falcon 9 Launch vehicle. নতুন প্রজন্মের অবতরণ ক্ষমতাসম্পন্ন এই উৎক্ষেপণযান এর সকল অংশই SpaceX এর নিজস্ব তত্ত্বাবধায়নে প্রস্তুতকৃত। চন্দ্রগামী Saturn V রকেটের পরে বর্তমান রকেটগুলোর মধ্যে একমাত্র Falcon এরই আছে Engine out situation overcome ability. যাত্রাপথে একটি বা দুটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেলেও বাকি ইঞ্জিনগুলো দিয়েই সফলভাবে মিশন সমাপ্ত করে আসার ক্ষমতা রয়েছে Falcon উৎক্ষেপণযানের। CRS-1 মিশনে উড্ডয়নের মিনিটখানেক পরেই একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়ার পরেও বাকি আটটি কার্যকরী ইঞ্জিনের সাহায্যেই মিশনটি সফলভাবে সমাপ্ত হয়। ৭০ মিটার লম্বা Falcon 9 উৎক্ষেপণযান এর বাহ্যিক কাঠামো প্রধানত চারটি অংশে বিভক্ত। যথাক্রমে First stage, Inter-stage, Second stage এবং Pay-load Fairing.
First Stageরকেটের ইঞ্জিন থেকে শুরু করে গ্রিড ফিন সংযুক্ত স্থান পর্যন্ত অংশকে বলা হয় ফার্স্ট স্টেজ। মূলত এই স্টেজটিই রকেটের প্রধান ও ব্যয়বহুল অংশগুলো বহন করে এবং পুনঃব্যবহারযোগ্য রকেটের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এই অংশটিই পৃথিবীতে ফিরে এসে অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছে। ফার্স্ট স্টেজের অভ্যন্তরে দুটো ফ্লুইড ট্যাঙ্ক রয়েছে। নিচের ট্যাঙ্কটি জ্বালানী ট্যাঙ্ক। এখানে রকেটের মূল জ্বালানী বা প্রোপাল্যান্ট জমা থাকে। এর উপরে রয়েছে তরল অক্সিজেনের ট্যাঙ্ক। অ্যালুমিনিয়াম ডোম এর সাহায্যে LOX tank (Liquid oxygen tank) কে Fuel Tank থেকে পৃথক রাখা হয়। ট্যাঙ্কের কেন্দ্রগামী একটি টিউব দিয়ে তরল অক্সিজেন ইঞ্জিনে পৌঁছে।
Inter stage: উড্ডয়নের পর একটি পূর্বনির্ধারিত উচ্চতায় পৌঁছে স্টেজ সেপারেশনের মাধ্যমে রকেটের ফার্স্ট স্টেজ পৃথক হয়ে ভূপৃষ্ঠে অবতরণের জন্য ফিরে আসে। ফার্স্ট স্টেজ ও সেকেন্ড স্টেজ এর মধ্যবর্তী সংযোগকারী অংশকে ইন্টার-স্টেজ বলা হয়। স্টেজ সেপারেশন এর সময় সেকেন্ড স্টেজ থেকে ফার্স্ট স্টেজকে পৃথকীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় যান্ত্রিক কৌশল ইন্টার-স্টেজেই সংযুক্ত থাকে। এছাড়া সেকেন্ড স্টেজ এর ইঞ্জিনের উন্মুক্ত অংশও এই স্টেজের ভেতরেই অবস্থান করে।
Second stage: রকেটের ফার্স্ট স্টেজ ও ইন্টার-স্টেজ এর উপরে অবস্থিত সেকেন্ড স্টেজ। এটির গঠন ছোট আকৃতির ফার্স্ট স্টেজের মতই। উপরে LOX tank, তার নিচে Fuel tank, LOX transfer tube এবং সবশেষে Merlin Vacuum Engine (MVac) এর সমন্বয়ে সেকেন্ড স্টেজ গঠিত।
স্টেজ সেপারেশনের পর স্পেসক্রাফট কিংবা পে-লোড কে নির্দিষ্ট কক্ষপথে নিয়ে যেতে এই ইঞ্জিনটি কার্যকরী হয়। একাধিক পে-লোডকে কক্ষপথের বিভিন্ন স্থানে ও একাধিক আলাদা কক্ষপথে নিয়ে যাবার প্রয়োজনে এই ইঞ্জিনটি একাধিকবার কার্যকর ও বন্ধ হতে সক্ষম।
Merlin Vaccum Engine (MVac D)
Pay-load Fairing: মহাকাশে মূলত যা উৎক্ষেপণ করা হবে তাকে সাধারণ ভাষায় বলা হয় পে-লোড। পে-লোড হতে পারে কোনো মালামাল বহনকারী মহাকাশযান বা Cargo spacecraft, হতে পারে কোনো নভোচারী বহনকারী মহাকাশযান বা Crew spacecraft অথবা হতে পারে এক বা একাধিক স্যাটেলাইট কিংবা যে কোনো কিছু। উড্ডয়নের সময় বায়ুমণ্ডলীয় ঘর্ষণ, Aerodynamic Stress ইত্যাদি থেকে নিরাপদ রাখতে স্পেসক্রাফট ব্যতীত অন্যান্য পে-লোড একটি খাঁচার মধ্যে আবদ্ধ থাকে। একে পে-লোড ফেয়ারিং বলা হয়। Falcon উৎক্ষেপণযানে ১৭ ফুট লম্বা পে-লোড ফেয়ারিং সংযুক্ত থাকতে পারে।

Falcon 9 Launch Vehicle এর প্রধান যন্ত্রাংশসমূহ

Merlin Engine: রকেট এর উড্ডয়নের জন্য প্রথমেই বিবেচ্য হল ইঞ্জিন। Falcon 9 রকেটের জন্য SpaceX বিশেষভাবে প্রস্তুত করেছে Merlin Engine. সম্প্রতি Falcon Heavy রকেটের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে 1D প্রজন্মের Merlin Engine – M1D.
SpaceX এর তৈরি শততম Merlin 1D Engine
এই ইঞ্জিন উড্ডয়নের শুরুতে ৮৪৫ কিলোনিউটন বা ১,৯০,০০০ পাউন্ড থ্রাস্ট দিতে সক্ষম এবং ক্রমান্বয়ে তা সর্বোচ্চ ৯১৪ কিলোনিউটন বা ২,০৫,৫০০ পাউন্ড পর্যন্ত হতে পারে। এর জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয় রকেট গ্রেড কেরোসিন। একে প্রোপাল্যান্ট বলা হয়। আর জ্বালানীকে ‘জ্বালানো’র জন্য সহায়ক হিসেবে থাকে তরল অক্সিজেন। প্রোপাল্যান্ট কে নির্দিষ্ট চাপে রাখার জন্য ট্যাঙ্কে ব্যবহৃত হয় নিষ্ক্রিয় গ্যাস হিলিয়াম। এই ইঞ্জিনটিই এখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত সবচেয়ে কর্মদক্ষ (efficient) রকেট ইঞ্জিন।
প্রতিটি Falcon 9 রকেটে এমন ৯ টি ইঞ্জিন অক্টাওয়েব ফরমেশনে সংযুক্ত থাকে। একটি ইঞ্জিন মাঝে রেখে এর চারদিকে আরো আটটি ইঞ্জিন ঘিরে থাকে। অন্যান্য রকেটে সাধারণত 3×3 বর্গাকারভাবে ইঞ্জিনগুলো সাজানো হয়।
Octaweb formation of Merlin Engine
Structure Tank: রকেটের পাদদেশ থেকে পে-লোড পর্যন্ত ব্যারেল আকৃতির সবচেয়ে লম্বা বাহ্যিক অংশটিই হল স্ট্রাকচার ট্যাঙ্ক। ফার্স্ট ও সেকেন্ড স্টেজের Lox tank, Fuel tank, ইন্টার-স্টেজের Separation mechanism ইত্যাদি সবই এই স্ট্রাকচার ট্যাঙ্কের ভেতরে অবস্থান করে। Falcon 9 এর Structure tank অ্যালুমিনিয়াম-লিথিয়াম সংকর দ্বারা প্রস্তুতকৃত। লিথিয়াম সংকরায়নের কারণে এটি অ্যালুমিনিয়ামের চেয়ে হালকা ও একই সাথে শক্তিশালী। প্রায় ২০০ ফুট লম্বা ও ১২ ফুট ব্যাসের স্ট্রাকচারের একাধিক ছোট ছোট খণ্ড প্রস্তুত করে উন্নত Friction Stir Welding পদ্ধতিতে জোড়া দিয়ে লম্বা পূর্ণাঙ্গ ট্যাঙ্ক স্ট্রাকচার তৈরি করা হয়।
Falcon 9 Tank Structure
Landing Leg: কার্বন ফাইবার ও মৌমাছির বাসার মত দেখতে Aluminum Honycomb দ্বারা তৈরি চারটি অবতরণ কাঠামো রকেটের নিচের অংশ সংযুক্ত থাকে। চারটি কাঠামো প্রতিসমভাবে রকেটের নিচের অংশের চারদিকে সংযুক্ত থাকে। উড্ডয়নের সময় এগুলো ভাজ হয়ে রকেটের গায়ে লেগে থাকে এবং অবতরণের পূর্বে উন্মুক্ত হয়।
Falcon 9 Landing Leg
Grid Fin: রকেটের ফার্স্ট স্টেজের শেষভাগে চার ফুট বাই পাঁচ ফুট আকারের পাখার মত অংশ সংযুক্ত রয়েছে। এই পাখার মত অংশ গুলোর নড়াচড়ার সাহায্যেই অবতরণের জন্য রকেটকে বিভিন্ন দিকে প্রায় ২০ ডিগ্রির মত ঘুরানো হয়। একে গ্রিড ফিন বলা হয়। তাপসহ এই গ্রিড ফিনগুলো বর্তমানে টাইটানিয়াম দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে।
Grid Fin
৭০ মিটার (২২৯ ফুট) লম্বা ও ৩.৬৬ মিটার (১২ ফুট) ব্যাসের Falcon 9 Launch Vehicle দ্বারা Lower Earth Orbit (LEO) এ পাঠানো যাবে ২২,৮০০ কেজি পে-লোড। Geosynchronous Transfer Orbit (GTO) এবং Mars বা মঙ্গল গ্রহে পাঠানো যাবে যথাক্রমে ৮,৩০০ কেজি ও ৪,০২০ কেজি পে-লোড।
Falcon 9 এর প্রতিবার উৎক্ষেপণে ক্রেতাকে গুণতে হয় ৬২ মিলিয়ন ডলার। আর রকেট তৈরিতে শুধুমাত্র ফার্স্ট স্টেজ এর জন্যই ব্যয় হয় প্রায় ৭৫ শতাংশ। তাই ফার্স্ট স্টেজ অবতরণ ও পুনঃব্যবহারযোগ্য হলে প্রতিবার উৎক্ষেপণে খরচ কমে আসবে নাটকীয়ভাবে। প্রতিটি ইঞ্জিন আনুমানিক ১২-১৫ বার উৎক্ষেপণের জন্য ব্যবহার করা যাবে। এতে রকেট তৈরিতে যে সাশ্রয় হবে তার অর্ধেক যদি ক্রেতাকে ছাড় দেয়া হয় তাহলে ৬২ মিলিয়ন ডলারের স্থলে প্রতিবার উৎক্ষেপণ মূল্য হবে ৪৮.৩ মিলিয়ন ডলার। আর সাশ্রয়ের পুরোটাই যদি ক্রেতাকে ছাড় দেয়া হয় তাহলে প্রতিবার উৎক্ষেপণ মূল্য হ্রাস পাবে প্রায় ৪০ শতাংশ, নেমে আসবে ৩৭ মিলিয়ন ডলারে।

Falcon Heavy Launch Vehicle

Falcon 9 & Falcon Heavy Launch Vehicle
Falcon Heavy মূলত Falcon 9 উৎক্ষেপণযানের উন্নত ও অধিক ভর উৎক্ষেপণ ক্ষমতা সম্পন্ন বর্ধিত রূপ। সরলভাবে বললে তিনটি Falcon 9 রকেটের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে Falcon Heavy. Falcon 9 রকেটের ফার্স্ট স্টেজ এর দু’পাশে আরো দুটো একই রকমের ফার্স্ট স্টেজ সংযুক্ত করা হয়েছে Falcon Heavy উৎক্ষেপণযানে অধিক উড্ডয়ন ক্ষমতা প্রদানের জন্য। দু’পাশের দুটো অতিরিক্ত ফার্স্ট স্টেজ কোরকে সাইড কোর বা সাইড বুস্টার বলা হয়। সাইড বুস্টারদ্বয় কেন্দ্রীয় কোরের সাথে রকেটের পাদদেশে ও ফার্স্টে স্টেজের উপরে LOX tank এর শেষভাগে সংযুক্ত থাকে। প্রতিটি কোরের অভ্যন্তরীণ গঠন Falcon 9 রকেটের সমতুল্য। Falcon Heavy এর গঠনে অতিরিক্ত হিসেবে সংযুক্ত করা হয়েছে Booster separation mechanism. উড্ডয়নের সময় তিনটি কোরই পূর্ণরূপে কার্যকরী হলেও উড্ডয়নের খানিকক্ষণ পরেই কেন্দ্রীয় কোরের ইঞ্জিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিতভাবে সীমিত হয়ে যায়। নির্ধারিত উচ্চতায় গিয়ে সাইড বুস্টারদ্বয় মূল কেন্দ্রীয় কোর থেকে পৃথক পৃথিবীতে হয়ে ফিরে আসে। সাইড বুস্টার পৃথক হবার পর পুনরায় কেন্দ্রীয় কোরের ইঞ্জিন পরিপূর্ণভাবে কার্যকরী হয় উৎক্ষেপণযানকে নির্দিষ্ট উচ্চতায় নিয়ে যাবার জন্য। তারপর একটি নির্দিষ্ট সময় পরে নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছে মুল কেন্দ্রীয় কোর সেকেন্ড স্টেজ থেকে পৃথক হয়ে ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে। Falcon 9 এবং Falcon Heavy এর সেকেন্ড স্টেজ প্রায় অবিকল। ফার্স্ট স্টেজ পৃথকীকরণের পর সেকেন্ড স্টেজের MVac D ইঞ্জিন কার্যকরী হয়ে পে-লোডকে নির্ধারিত কক্ষপথে নিয়ে যায়।
যেহেতু Falcon Heavy উৎক্ষেপণযানের গঠন তিনটি Falcon 9 উৎক্ষেপণযানের সমতুল তাই এর নানা পরিমাপগত মানও Falcon 9 এর প্রায় তিনগুণ। Falcon Heavy উৎক্ষেপণযানের তিনটি কোরের মোট ২৭ টি Merlin Engine একত্রে প্রায় ২২,৮১৯ কিলোনিউটন (৫১,৩০,০০০ পাউন্ড) থেকে ২৪,৬৮১ কিলোনিউটন (৫৫,৪৮,৫০০ পাউন্ড) পর্যন্ত থ্রাস্ট তৈরি করতে সক্ষম।
Falcon Heavy Engine Arrangement – Three Octaweb Structure
এতে করে Lower Earth Orbit (LEO) এ পাঠানো যাবে ৬৩,৮০০ কেজি পে-লোড। Geosynchronous Transfer Orbit (GTO) তে ২৬,৭০০ কেজি পে-লোড এবং মঙ্গল গ্রহ ও প্লুটো তে পাঠানো যাবে যথাক্রমে ১৬,৮০০ কেজি ও ৩,৫০০ কেজি পে-লোড।
অন্যান্য অনুপাত তিনগুণ হলেও Falcon Heavy উৎক্ষেপণযানে পে-লোড এর তুলনায় উৎক্ষেপণ খরচ কমে আসবে প্রায় অর্ধেক। Falcon 9 এর তুলনায় প্রায় তিনগুণ পে-লোড বহন করা যাবে মাত্র দেড়গুণ খরচে। যেখানে Falcon 9 এর প্রতিবার উৎক্ষেপণ খরচ ৬২ মিলিয়ন ডলার সেখানে তিনগুণ পে-লোড বহনে সক্ষম Falcon Heavy এর প্রতিবার উৎক্ষেপণ খরচ ৯০ মিলিয়ন ডলার।
চন্দ্রগামী অ্যাপোলো মিশনে ব্যবহৃত উৎক্ষেপণযান Saturn V এর পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পে-লোড বহনকারী উৎক্ষেপণযান হচ্ছে SpaceX এর Falcon Heavy Launch Vehicle. অ্যাপোলো মিশনে ব্যবহৃত Saturn V উৎক্ষেপণযানের পে-লোড বহন ক্ষমতা ছিল পৃথিবীর কক্ষপথের জন্য প্রায় ১৩০ টন ও চাঁদে প্রেরণের জন্য প্রায় ৪৩.৫ টন; যা Falcon Heavy এর পে-লোড বহন ক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ।
Launch Vehicles according to Payload to LEO

Dragon Spacecraft

Dragon Space Craft of SpaceX
SpaceX শুরু থেকেই মহাশূন্যে মানব প্রেরণের চিন্তা মাথায় রেখে কাজ করছে। সেই প্রেক্ষিতে তৈরি করা হয়েছে ও হচ্ছে Dragon Space Craft. প্রধানত দু’ধরণের স্পেসক্রাফট রয়েছে। কার্গো ক্রাফট এবং ক্রু ক্রাফট। মহাকাশে মালামাল প্রেরণ, যেমন ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন এ মালামাল সরবরাহের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে Dragon Cargo Craft. ২০১২ সালে প্রথম কোনো ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠান সফলভাবে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে কার্গো ক্রাফট পাঠিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করল। বর্তমানে Dragon Crew Craft এর শেষভাগের তৈরির কাজ চলছে। নভোচারী বহনকারী যানের জন্য অভ্যন্তরীণ জীবনরক্ষাকারী ব্যবস্থা ও জরুরী অবস্থা মোকাবেলায় সর্বাত্মক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সমন্বয়ের কাজ চলছে। রকেটে যান্ত্রিক ত্রুটি কিংবা বিস্ফোরণজনিত যেকোনো জরুরী অবস্থায় নভোচারীদের নিরাপদ রাখতে Crew Dragon কে মুহূর্তের মধ্যে রকেট থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে দিতে Emergency Abort system এর টেস্ট সম্পন্ন হয়েছে ২০১৫ সালের ৬ মে। ড্রাগন মহাকাশযানে করে মানুষের মহাশূন্যে ভ্রমণের প্রথম টেস্ট ফ্লাইট এবছরই হবার কথা রয়েছে।
Dragon Cargo Craft
Dragon Space Craft কে তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত করা যেতে পারে। মালপত্র কিংবা নভোচারী বহনকারী মূল যান গঠনের দিক থেকে মাঝে অবস্থিত। এর উপরের দিকে থাকা Docking Mechanism বা Berthing Mechanism এর মাধ্যমে এটি ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের সাথে সংযুক্ত হয়। উড্ডয়নের সময় বায়ুর ঘর্ষণজনিত ক্ষয়ক্ষতি রোধে এই অংশের উপরে একটি গম্বুজ আকৃতি শিল্ড থাকে। বায়ুমণ্ডলে বাইরে গিয়ে এই শিল্ড স্পেসক্রাফট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বার্থিং মেকানিজমের নিচে থাকে মূল কার্গো এরিয়া। এই অংশে নির্দিষ্ট চাপে মালামাল বহন করা হয়। ক্রু ক্রাফটের ক্ষেত্রে এই অংশে জীবনরক্ষাকারী ব্যবস্থা সহযোগে নভোচারীদের আসন ব্যবস্থা সুবিন্যস্ত থাকবে। এ অংশের পার্শ্ব দেয়ালে একটি দরজা থাকে যার সাহায্যে ভূমিতে অবস্থান করা অবস্থায় মালামাল ও নভোচারীগণকে স্পেসক্রাফটে প্রবেশ করানো ও বাইরে নিয়ে আসা যায়। মূল যানের কার্গো এরিয়ার নিচের অংশকে বলা হয় সার্ভিস এরিয়া। যানের গতি ও অন্যান্য নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট যন্ত্রাংশ ও কৌশল অবস্থান করে সার্ভিস এরিয়ায়। এখানে নিয়ন্ত্রণকারী কম্পিউটার, পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা, এন্টেনা, গতি ও দিক নিয়ন্ত্রক থ্রাস্টার এবং সমুদ্রপৃষ্ঠে অবতরণের জন্য দরকারি একাধিক প্যারাসুট থাকে। এই অংশটিই মূল যানের শেষ অংশ। এর তলদেশে থাকে বিশেষ তাপসহ পদার্থের তৈরি হিট শিল্ড যা প্রায় ৩০০০-৪০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় টিকে থাকতে সক্ষম। স্পেসক্রাফট পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় যখন উচ্চগতিতে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে তখন বায়ুর ঘর্ষণে সৃষ্ট উচ্চতাপ থেকে মূল যানের অন্যান্য অংশকে সুরক্ষা প্রদান করাই হিট শিল্ডের কাজ। ড্রাগন স্পেসক্রাফটের বার্থিং মেকানিজম থেকে হিটশিল্ড পর্যন্ত এই অংশটুকুই পৃথিবীতে ফিরে আসে।
হিট শিল্ডের নিচে সংযুক্ত থাকে ট্রাঙ্ক। এটিতে নির্দিষ্ট চাপে রাখার প্রয়োজন নেই এমন মালামাল বহন করা হয়। এর দু’পাশে দু’টো সোলার প্যানেল থাকে যা স্পেসক্রাফটের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন ও সরবরাহ করে থাকে। এই সোলার প্যানেল দুটো উড্ডয়নের সময় ক্রাফটের ভেতরে ভাজ হয়ে থাকে। কক্ষপথে গিয়ে ক্রাফটের বাইরে উন্মুক্ত হয়ে কার্যকরী হয়। মূল যান যখন পৃথিবীতে ফিরে আসতে শুরু করে তখন হিট শিল্ডের নিচ থেকে ট্রাঙ্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
২০১২ সালের ৩০ অক্টোবর প্রথমবারের মত Dragon Cargo Craft ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে মালামাল সরবরাহ করে সেখান থেকেও কিছু মালামাল নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে।
প্রথম রিসাপ্লাই মিশন শেষে ফিরে আসা ‘ড্রাগন কার্গো ক্রাফট’

Falcon Heavy First Test Flight

SpaceX এর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের শুরুতেই যুক্ত হয়েছে Falcon Heavy রকেটের প্রথম সফল টেস্ট ফ্লাইট। ৬ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সময় দুপুর ১:৩০ মিনিট থেকে উৎক্ষেপণ কার্যক্রম শুরু হবার কথা থাকলেও বায়ুপ্রবাহের তারতম্যের কারণে পূর্বনির্ধারিত সময়ের চেয়ে দুই ঘণ্টার অধিক সময় পরে বিকাল ৩:৪৫ মিনিটে যানটির সফল উৎক্ষেপণ সম্পন্ন হয়। এই একটা টেস্ট ফ্লাইটে SpaceX যেমন বেশ কিছু পরীক্ষণ ও চ্যালেঞ্জ রেখেছে তেমনি সামান্য বিফলতার পরিবর্তে পেয়েছে অনেকখানি সাফল্য ও পরবর্তী গবেষণার জন্য একগাদা ব্যবহারিক উপাত্ত।
উড্ডয়নের ১ ঘণ্টা ২৫ মিনিট পূর্বে ট্যাঙ্কে জ্বালানি বোঝাই কার্যক্রম শুরু হয়, ৪৫ মিনিট পূর্বে LOX Tank এ তরল অক্সিজেন পূর্ণ করা শুরু হয়। উড্ডয়নের ১২ মিনিট পূর্বে সেকেন্ড স্টেজে জ্বালানী সরবরাহ সমাপ্ত হয়, ৬-৭ মিনিট পূর্বে ফার্স্ট স্টেজের তিনটি বুস্টারে জ্বালানি প্রবেশ করানো সম্পন্ন হয়, ৩-৪ মিনিট পূর্বে ফার্স্ট স্টেজের LOX Tank এবং ২ মিনিট পূর্বে সেকেন্ড স্টেজের LOX Tank অক্সিজেনে পরিপূর্ণ করা সম্পন্ন হয়। রকেটে প্রোপাল্যান্ট ভর্তি করতে করতেই অন্য বিশেষজ্ঞ দল রকেটের অন্যান্য অবস্থা যেমন ইঞ্জিনের সর্বশেষ অবস্থা, ভালভ, থ্রাস্ট ভেক্টর, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ইত্যাদির সর্বশেষে নিরীক্ষণ করে উড্ডয়নের উপযুক্ততা ঘোষণা করেন। উড্ডয়নের এক মিনিট পূর্বে উৎক্ষেপণযানের নিজস্ব স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উড্ডয়নের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। উড্ডয়নের পাঁচ সেকেন্ড পূর্বে দুটো সাইড বুস্টার ইঞ্জিন ও তিন সেকেন্ড পূর্বে কেন্দ্রীয় কোর বুস্টার ইঞ্জিন কার্যকর হয় ও পাঁচ সেকেন্ডে সম্মিলিতভাবে উড্ডয়নের জন্য প্রয়োজনীয় থ্রাস্ট তৈরি করে এবং সফলভাবে প্রথমবারের মত Falcon Heavy উৎক্ষেপণযানের উড্ডয়ন ঘটে।
উড্ডয়নের পর রকেট এগিয়ে যায়, এর গতি ও উচ্চতা বাড়তে থাকে; সেই সাথে বাড়তে থাকে গতি ও বায়ুচাপের ফলে উৎক্ষেপণযানের উপর সৃষ্টি হওয়া Aerodynamic Stress. উড্ডয়নের ১ মিনিট ৬ সেকেন্ড পর ১০.৫ কিঃমিঃ উচ্চতায় পৌঁছে এই স্ট্রেস হয়ে ওঠে সর্বোচ্চ। সর্বোচ্চ Aerodynamic stress এ টিকে থেকে সফলভাবে এগিয়ে যেতে থাকে Falcon Heavy. ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে রকেটের গতি শব্দের গতিকে অতিক্রম করে।
উড্ডয়নের ২ মিনিট ২৯ সেকেন্ড পরে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫৭ কিঃমিঃ উচ্চতায় পৌঁছে সাইড বুস্টারদ্বয়ের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়, ইঞ্জিন বন্ধ হবার চার সেকেন্ড পরে কেন্দ্রীয় কোর থেকে সাইড বুস্টারদ্বয় বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য যাত্রা শুরু করে।
এদিকে সাইড বুস্টার বিচ্ছিন্ন হবার পর কেন্দ্রীয় কোর রকেটকে নিয়ে যেতে থাকে অধিক উচ্চতায়। উড্ডয়নের ৩ মিনিট ৪ সেকেন্ড পরে ৮৪ কিঃমিঃ উচ্চতায় উঠে কেন্দ্রীয় কোর এর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। ইঞ্জিন বন্ধ হবার তিন সেকেন্ড পরে সেকেন্ড স্টেজ থেকে ফার্স্ট স্টেজ বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসতে শুরু করে। ফার্স্ট স্টেজ বিচ্ছিন্ন হবার ৮ সেকেন্ড পর সেকেন্ড স্টেজের MVac ইঞ্জিন কার্যকরী হয় ও পে-লোডকে নির্দিষ্ট কক্ষপথ ও অবস্থানের দিকে নিয়ে যেতে থাকে।
উড্ডয়নের ৩ মিনিট ৪৯ সেকেন্ড পর পে-লোড ফেয়ারিং উন্মুক্ত হয় এবং টেস্ট ফ্লাইটের জন্য ব্যবহৃত চমকপ্রদ পে-লোড দেখতে পাওয়া যায়। Falcon Heavy এর প্রথম টেস্ট ফ্লাইটে পে-লোড হিসেবে নেয়া হয়েছিল SpaceX এর প্রতিষ্ঠাতা Elon Musk এর ব্যক্তিগত ‘চেরি রেড টেসলা রোডস্টার’ গাড়িটি। গাড়ির যাত্রী হিসেবে উপস্থিত ছিল একটি ডামি মহাকাশচারী যার নাম দেয়া হয় ‘স্টারম্যান’। স্টারম্যানের পরনে ছিল SpaceX এর ডিজাইন করা স্পেসস্যুটের মডেল যা পরবর্তীতে SpaceX এর মনুষ্য মহাকাশযাত্রা মিশনে নভোচারীগণ পরিধান করবেন।
Elon Musk’s Cherry Red Tesla RoadStar
এখানেই শেষ নয়; টেস্ট ফ্লাইটে Mass simulator হিসেবে ব্যবহৃত গাড়িতে রাখা ছিল মাত্র এক ইঞ্চি ব্যাসের ক্ষুদ্র একটি বিশেষ কাঁচের ডেটা স্টোরেজ ডিস্ক, আর তাতে লিপিবদ্ধ ছিল আইজ্যাক আসিমভ এর ফাউন্ডেশন ট্রিলজি সাইফাই। ২৫ মিঃমিঃ ব্যাসের ‘Arch’ স্টোরেজ ডিভাইসটি একটি 5D Laser optical quartz storage device. প্রচলিত ডিভাইস স্টোরেজের বদলে নতুন উদ্ভাবিত এই ডিভাইসটি স্পেসে পাঠানোর কারণ হচ্ছে এই ডিভাইসের অতি উচ্চ ডেটা স্টোরেজ ক্ষমতা এবং মহাকাশের কঠিন পরিবেশেও দিব্যি টিকে থাকার বৈশিষ্ট্য।
কাঁচের ডিস্কে লেজার প্রয়োগ করে কয়েক স্তরে ‘ন্যানোস্ট্রাকচারড ডট’ তৈরি করার মাধ্যমে তথ্য সংরক্ষণ করার এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে একটি ১২ সেঃমিঃ বা ব্লু-রে ডিস্কের আকৃতির ডিস্কে সংরক্ষণ করা যাবে ৩৬০ টেরাবাইট তথ্য। তাছাড়া কাঁচ একটি বেশ টেকসই পদার্থ হওয়ায় প্রায় ১০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও টিকে থাকতে সক্ষম। কক্ষ তাপমাত্রায় ডিস্কের তথ্য অপরিবর্তিত থাকবে তাত্ত্বিকভাবে অসীম সময় পর্যন্ত। আর ১৯০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রাতে এই ডিস্কের তথ্য টিকে থাকতে পারবে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর যা মহাবিশ্বের বয়সের সমান সময়। স্বল্প পরিসরে টেকসইভাবে অধিক পরিমাণে তথ্য সংরক্ষণের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এই ডিভাইসটি SpaceX এর লক্ষ্য দুর মহাকাশে মানব বসতি গড়ার প্রত্যয়েই যেন আবিষ্কৃত হয়েছে, আর তার নমুনা হিসেবেই যেন মহাশূন্যে প্রেরণ করা হল এই ডিভাইসটি।
Arch – 5D Laser optical quartz storage device
উড্ডয়নের ৬ মিনিট ৪১ সেকেন্ড পর অবতরণের পথে সাইড বুস্টারদ্বয়ের ইঞ্জিন পুনরায় কার্যকরী হয় অবতরণের নির্দিষ্ট অবস্থান ও গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য। ৬ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড পর কেন্দ্রীয় কোরের ইঞ্জিন পুনঃকার্যকরী হয় অবতরণের নিমিত্তে। উড্ডয়নের ৭ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড পরে দুটি সাইড বুস্টার ফ্লোরিডা’র Cape Canaveral Air Force Station এর পাশাপাশি দুটি ল্যান্ডিং জোনে একসাথে সফলভাবে অবতরণ করে। এই বুস্টারগুলোর প্রতিটি এর আগে একবার Falcon 9 উৎক্ষেপণযান এর মিশন শেষে অবতরণ করেছিল। Falcon Heavy টেস্ট ফ্লাইট থেকে এদের অবতরণ এই বুস্টারগুলোর জন্য দ্বিতীয়বারের মত সফল অবতরণ।
সাইড বুস্টার অবতরণের ২১ সেকেন্ড পরে কেন্দ্রীয় কোর বুস্টার এর অবতরণ করার কথা ছিল ফ্লোরিডা উপকূল থেকে ৩০০ মাইল দূরে ভাসমান স্বয়ংক্রিয় ড্রোনশিপের ওপর। অবতরণ মুহূর্তে গতিবেগ কমানোর জন্য নয়টির মধ্যে কমপক্ষে তিনটি ইঞ্জিন কার্যকরী হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেসময় কেন্দ্রীয় কোরের মাত্র একটি ইঞ্জিন কার্যকর হওয়ায় শেষ মুহূর্তে এটি গতি ও অবস্থান নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে ড্রোনশিপ থেকে প্রায় ৩০০ ফুট দূরে ঘণ্টায় ৩০০ মাইল বেগে সমুদ্রপৃষ্ঠে আছড়ে পরে বিধ্বস্ত হয়।
অপরদিকে সেকেন্ড স্টেজ, পে-লোড নিয়ে এগিয়ে চলছে নির্ধারিত কক্ষপথের দিকে। এরপর নির্দিষ্ট সময় পরপর নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছে আরো দুইবার ইঞ্জিন বন্ধ ও কার্যকর হয়ে পে-লোডকে চূড়ান্ত কক্ষপথে নিক্ষেপ করে। কেন্দ্রীয় কোর বিধ্বস্ত হবার পর দ্বিতীয় ব্যর্থতা হল সূক্ষ্মভাবে পূর্বনির্ধারিত কক্ষপথে পে-লোড স্থাপন করা যায়নি। টেসলা রোডস্টার পূর্বনির্ধারিত মঙ্গলের কক্ষপথ ছেড়েও আরো দূরবর্তী কক্ষপথে চলতে শুরু করেছে।
Falcon Heavy First Test Flight টি সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল SpaceX এর নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে। এই পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের সাফল্য ও ব্যর্থতার সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুত করলে সাফল্যের দিকটাই ভারী হবে।
সাফল্য –১. Falcon Heavy উৎক্ষেপণযানের সফল উড্ডয়ন।
২. Max Q বা সর্বোচ্চ Aerodynamic stress সফলভাবে অতিক্রম।
৩. সাইড বুস্টারদ্বয়ের সফল বিচ্ছিন্নতা ও প্রতিটির দ্বিতীয়বারের মত সফল অবতরণ।
৪. টেসলা রোডস্টার ও আর্ক স্টোরেজ ডিভাইস পে-লোড পৃথিবীর বাইরে প্রেরণ।
ব্যর্থতা ১. অবতরণের শেষ পর্যায়ে এসে কেন্দ্রীয় কোর অবতরণে ব্যর্থ হয়ে বিধ্বস্ত হয়। কিন্তু ব্যর্থতার পরেও এই ব্যর্থতার কারণ সংক্রান্ত ও পরবর্তীতে সফল অবতরণের জন্য প্রয়োজনীয় একগাদা তথ্য পাওয়া গেছে এই ফ্লাইট থেকে। প্রথম টেস্ট ফ্লাইট হিসেবে এটিকেও একটি প্রাপ্তি বলা যেতেই পারে।
২. পে-লোড পৃথিবীর বাইরে নিক্ষেপ করা গেলেও সূক্ষ্মভাবে কক্ষপথে স্থাপন করা সম্ভব হয় নি।

২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সাফল্য ও আপাত ব্যর্থতার মিশেলে একের পর এক আবিষ্কার ও ইতিহাস গড়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে Elon Musk এর SpaceX; যার সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে আমরা দেখতে পাই ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ তে Falcon Heavy উৎক্ষেপণযানের সফল উড্ডয়ন। এই ধারাবাহিকতায়ই হয়ত একদিন SpaceX এর হাত ধরে Crew Dragon এ চেপে মানুষ বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবে প্রতিবেশী কোনো গ্রহে।
SpaceX.com



    Publisher : SK NUR SALAM
    Published : 19-11-2018